বাানারীপাড়া প্রতিনিধি॥ নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া ও সুফিয়া কামালের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরতœ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে দেশে নারীর যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে তার ঢেউ আছড়ে পড়েছে বরিশালের বানারীপাড়ায়ও। এখানকার আত্ম প্রত্যয়ী নারীরাও দারিদ্রতা,বঞ্চনা,গঞ্জনা ও নির্যাতন পিছনে ফেলে নানা ভাবে জেগে উঠে পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে অবদান রেখে চলছেন। এদের মধ্যে জীবন সংগ্রামী ৫ নারী এবছর জয়িতার সম্মাননা পেয়েছেন। আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস উদযাপন উপলক্ষে তাদেরকে ‘জয়িতা’ নারী হিসেবে সংবর্ধিত করা হয়েছে। ৯ই ডিসেম্বর শীতের স্নিগ্ধ বিকেলে উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আয়োজনে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এ ৫ জয়িতাকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মোঃ শাহে আলম। বানারীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিপন কুমার সাহা এতে সভাপতিত্ব করেন। জীবন সংগ্রামী ৫ জয়িতার মধ্যে উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের আ. হক মিয়ার স্ত্রী নাজনিন হক মিনু ১০ ভাই বোনের মধ্যে ৫ম। স্কুল জীবনেই নিজে লেখাপড়া করার পাশাপাশি প্রতিবেশী গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের ফ্রি পড়াতেন। তখন থেকেই তিনি স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত থেকে নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়াতেন। যেসব গৃহবধু স্বামীর নির্যাতনের শিকার হতেন তাদের নিয়ে মহিলা সমিতি গঠন করে সঞ্চয় জমা রাখার ব্যবস্থা করতেন। ঝড়ে পড়া শিশুদের স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, খেলাধূলার সামগ্রী বিতরণ করে কোমলমতি শিশুদের মাদকসহ যাবতীয় অনৈতিক কাজ থেকে দূরে রাখা ও বাল্য বিয়ে বন্ধ করাসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তিনি নাগরিক উদ্যোগের মাধ্যমে বিভিন্ন পারিবারিক বিরোধের সালিশ,স্কুলের ক্যাম্পেইন এবং বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে সমাজের উন্নয়নমূলক কাজ করে থাকেন। তিনি নারী ও সমাজের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলছেন। উদয়কাঠি ইউনিয়নের তেতলা গ্রামের আবুল কালামের স্ত্রী তাসলিমা বেগম ৬ ভাই বোনের সংসারে ৫ম সন্তান। দরিদ্র কৃষক বাবার পক্ষে পরিবার চালানো কষ্টকর ছিল। তাই তিনি নিচের ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচ যোগাতেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নকালীন তাকে জোরপূর্বক বাল্যবিয়ে দেয়া হয়। স্বামীর বাড়ীতে থেকে হাঁস-মুরগী, ছাগল পালন ও হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করে পড়াশুনা চালিয়ে যান। অনেক কষ্ট করে এস. এস. সি পাস করে আর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি তার। এরপর ব্রাক পুষ্টি প্রকল্পে ৫শ’ টাকা বেতনে চাকুরী নেয়ার পাশাপাশি দর্জি প্রশিক্ষণ নিয়ে বেতনের টাকা জমিয়ে একটি সেলাই মেশিন ক্রয় করে বাড়িতে বসে টাকা উপার্জন করতে থাকেন। পরে আয়ের টাকা জমিয়ে ভাল জাতের একটি গাভী ক্রয় করেন। বর্তমানে ব্র্যাকে চাকরি, দজির্র কাজ করে এবং শিখিয়ে সব মিলিয়ে তার মাসিক আয় ২০-২৫ হাজার টাকা। তিনি অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী সংগ্রামী এক নারী। সৈয়দকাঠি ইউনিয়নের মসজিদ বাড়ি গ্রামের অনিল চন্দ্র বড়ালের স্ত্রী কনকলতা রানী অনেক কষ্ট করে বাড়িতে বসে সেলাই মেশিন চালিয়ে এবং ব্য্রাকে স্বাস্থ্য সেবিকা হিসেবে কাজ করে ও সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত থেকে তার সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। স্বামী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিল তারপরেও জীবনযুদ্ধে হার মানেন নি এ নারী।
তার বড় ছেলে চিকিৎসক ও ছোট ছেলে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে চাকুরী করছেন। কনকলতা রানী তাই আজ সফল জননী নারী। তার প্রচেষ্টায় ছেলেরা আজ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের বেতাল গ্রামের রফিকুল ইসলামের স্ত্রী ফারজানা ববি ২ ভাই বোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। তার ছোট ভাই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এবং বাবা দিনমজুর। জীবন যুদ্ধে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছেন এ নারী। তিনি এস. এস.সি, এইচ.এস.সি., অনার্স ও মাস্টার্স সকল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। মাস্টার্স পাশ করার পরেও অনেক চাকুরীর ইন্টারভিউ দিয়েও সরকারী চাকুরী নামের সোনার হরিণটি তার জীবনে অধরাই থেকে যায়। অবশেষে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে চাকুরীতে যোগদান করার ফলে তার সংসারের যাবতীয় অভাব দূর হয়। তাই ফারজানা ববি শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী এক আত্ম প্রত্যয়ী নারী। সদর ইউনিয়নের ব্রাক্ষ্মণকাঠি গ্রামের মৃত ছাদেক হোসেনের মেয়ে হাসি খানম বাল্য বিয়ে এবং যৌতুকের নির্মম শিকার। স্বামীর যৌতুকের দাবী পূরন করতে না পারায় স্বামীর সংসারে তার এবং সন্তানের ঠাঁই হয়নি। তিনি বর্তমানে বাবার বাড়ীতে থেকে নকশী কাঁথা সেলাইয়ের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যাগ তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ ও সন্তানের লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন করছেন। হাসি খানম নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নব উদ্যমে জীবন শুরু করে জীবন যুদ্ধে জয়ী এক সফল নারী।
Leave a Reply